বাংলাদেশে কৃষি এবং কৃষির অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান। খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার পিছনে অনেক কারণ বিদ্যমান থাকলেও ধানের নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সময়োপযোগী কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিশেষ করে ধান কর্তন যান্ত্রিকীকরণ, এবং সর্বোপরি কৃষকের অদম্য পরিশ্রম কৃষি উন্নয়নের ধারাকে অধিক বেগবান করেছে।
কৃষির আধুনিকীকরণ এবং টেকসই অগ্রযাত্রা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদন এবং উৎপাদন পরবর্তী পর্যায়ে নিরাপত্তা বিধান করার পাশাপাশি কৃষি উপকরণ, সময়, শ্রম এবং অর্থ সাশ্রয় করে এবং ফসলের নিবিড়তা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সবচেয়ে জটিল কাজ হলো সঠিক যন্ত্রপাতি নির্বাচন, নির্বাচিত কৃষি যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তির প্রবাহ বজায় রাখা, মাঠ পর্যায়ে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি সচল রাখা এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা। এসব কাজের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা অনস্বীকার্য।
কৃষি যন্ত্রপাতি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে টেকসই করার জন্য কৃষি প্রকৌশলীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। কারণ একজন কৃষি প্রকৌশলীই দেশের মাটি, ফসল, কৃষকের চাহিদা, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নির্বাচন, সনাক্তকরণ, প্রয়োজনীয় উন্নয়ন, অভিযোজন, এবং কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি (২য় পর্যায়: ২০১২-২০১৯) প্রকল্পের আওতায় সরবরাহকৃত ১৪০০টি কম্বাইন হারভেস্টার মাঠ পর্যায়ে স্বাভাবিক নিয়মেই এখন আর সচল নেই। সচল করার সুযোগও নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত “সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ” প্রকল্পের (জুলাই/২০২০- জুন/২০২৫) আওতায় দশ হাজারের অধিক কম্বাইন হারভেস্টার কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে।
তাছাড়া, কৃষির অন্যান্য প্রকল্প হতেও বিগত তিন-চার বছরে প্রায় দুই-তিনশত কম্বাইন হারভেস্টার কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, সরবরাহকৃত কম্বাইন হারভেস্টারের প্রায় ৩০-৪০ ভাগ মাঠ পর্যায়ে সচল নেই। অবশিষ্ট সচল হারভেস্টারকে সচল ও কার্যকর রাখা এবং সচল ও কার্যকর নয় এমন হারভেস্টারকে সচল ও কার্যকর করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন হলো কেন সচল নেই এবং কেন সচল রাখা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথমত কম্বাইন হারভেস্টার একটি অত্যন্ত জটিল এবং আধুনিক যন্ত্র। একটি আধুনিক কম্বাইন হারভেস্টারে তিন হাজারেরও অধিক চলমান এবং স্থির পার্টস বিদ্যমান। তারমধ্যে প্রায় আটশত চলমান পার্টস বিদ্যমান। চলমান পার্টসসমূহ যন্ত্র চালানোর সময় বেশি নষ্ট হয়ে থাকে।
চলমান পার্টসের মধ্যে প্রায় অর্ধেক পার্টস মাঠে চালানোর সময় দ্রুত নষ্ট হয় এবং যন্ত্র সচল রাখার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিস্থাপন করতে হয়। কম্বাইন হারভেস্টারের ধরণ এবং মডেল ভেদে তা ভিন্ন হয়ে থাকে। মাঠে কম্বাইন হারভেস্টার সচল রাখার জন্য বিভিন্ন কম্বাইন হারভেস্টারের ধরণ এবং মডেল ভেদে দ্রুত চলমান পার্টসসমূহ নির্ধারণ করতে হবে। নির্ধারিত পার্টসসমূহ বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে ভর্তুকির মাধ্যমে সরবরাহকৃত যন্ত্রসমূহের বিক্রয়োত্তর মেরামত সেবা সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিন বছর দিয়ে থাকে। কিন্তু পার্টসের অপ্রতুলতার জন্য এই সেবা অনেক সময় বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে পার্টস থাকলেও মূল্য বেশি থাকার কারণে কৃষক অনেক সময় ক্রয় করতে অসমর্থ হয় বা বিলম্ব হয়।
পার্টস এর মূল্য বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো পার্টস আমদানিতে অধিক মূল্য সংযোজন কর। পার্টসের প্রকার ভেদে এই মূল্য সংযোজন করের পরিমান ৪০-৬০ ভাগ। কম্বাইন হারভেস্টারকে মাঠে সচল এবং কার্যকর রাখতে এই মূল্য সংযোজন কর কমিয়ে আনতে হবে অথবা শুল্কমুক্ত আমদানি নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকের নিয়মিত অভিযোগ যন্ত্রের মান নিয়ে। যদিও উন্নয়ন সহায়তার আওতায় সরবরাহকৃত সবকটি যন্ত্রই কারিগরি দিক দিয়ে বিশ্বমানের। তারপরও কৃষকের এমন অভিযোগের অন্যতম কারণ হলো- কম্বাইন হারভেস্টার একটি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এবং অসংখ্য পার্টস দিয়ে তৈরি যন্ত্র যা সচল এবং কার্যকর রাখার জন্য যন্ত্র চালককেও যন্ত্রের পার্টস সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান, চালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, দ্রুত চলমান পার্টস মেরামত এবং পরিবর্তনের সক্ষমতা থাকা আবশ্যক। এমনকি ধান কাটার সময় মাটির আর্দ্রতা, মাটির বহন ক্ষমতা, ফসলের ধরন, ঘনত্ব, উচ্চতা, খাড়া কিংবা হেলানো অবস্থা, ফসলের পরিপক্কতা, কর্তনের উচ্চতা বিবেচনায় নিয়ে যন্ত্রের অনেক অংশের সমন্বয় করতে হয়।
এই সমন্বয়ে ঘাটতি হলে একদিকে যেমন দ্রুত চলমান পার্টস নষ্ট হয়ে যায়, অন্যদিকে মেশিনের কার্যকর ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই ভালো যন্ত্রের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও রাতারাতি প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করা সম্ভব নয়। তথাপি প্রশিক্ষিত চালক তৈরির কাজ চলমান রাখতে হবে। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো- তা হলো একজন কম্বাইন হারভেস্টার চালক বছরে ৮০-৯০ দিন যন্ত্র চালানো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। বছরের বাকি সময় অন্য পেশায় ব্যস্ত থাকায় যন্ত্রের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত করা সম্ভব হয় না। এটিও যন্ত্র সচল না থাকার অন্যতম একটি কারণ।
অন্যদিকে মওসুম শেষে কম্বাইন হারভেস্টার দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকে। দীর্ঘ অব্যবহৃত সময় কম্বাইন হারভেস্টর যন্ত্রটি যাতে ভালো থাকে এবং পরবর্তী মওসুমে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করা আবশ্যক। প্রথমত মেশিনকে অবশ্যই শেডে রাখতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি বা কূয়াশায় মেশিনের লোহার অংশে বা ক্রলারের হুইল বা শ্যাফটে মরিচা পরতে না পারে। বাস্তবে অনেকে মওসুম শেষে জায়গার অভাবে মাঠে, রাস্তার পাশে, কিংবা উন্মুক্ত জায়গায় রেখে দেয় – ফলে মেশিন অল্প সময়েই অচল এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া, মাসে অন্তত একবার ব্যাটারি চার্জ দেয়া, রেডিয়েটর ও অন্যান্য তাপ এক্সচেঞ্জার পরিস্কার রাখা, মেশিনের স্ক্র্যাচ পড়া অংশে রং করা, মেশিনের সকল গ্রীস-ফিটিংগুলিতে গ্রীস বা অয়েল দেয়া, মেশিনের বিভিন্ন অয়েল, ফিল্টার পরিবর্তন করা, সকল বেল্ট আলগা করে সংরক্ষণ করা, ক্রলারের টেনশন কমিয়ে রাখা যাতে ক্রলার এবং ক্রলারের হুইলের মধ্যে আনুমানিক ১০ মিমি গ্যাপ থাকে, মাসে অন্তত ২ বার ইজ্ঞিন চালু করা এবং স্থির রেখে আনুমানিক ১০ মিনিট চালু রাখা, জ্বালানী ট্যাংক জ্বালানী দ্বারা ভরাট করে রাখা ইত্যাদি সময় এবং ব্যয় সম্পৃক্ত বিষয় হওয়ায় অনেকাংশেই তা পালন করা হয় না। ফলে যন্ত্র হতে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব হয় না।
এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদে বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিএডিসি অফিসে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারণ ভর্তুকিকৃত যন্ত্রসমূহের মালিকানা সরকার এবং কৃষক উভয়ই। সঠিকভাবে কম্বাইন হারভেস্টার সংরক্ষণ করে নিজের এবং দেশের অর্থ সাশ্রয় করার মাধ্যমে টেকসই যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
টেকসই যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরনের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। তারজন্য মাঠে সরবরাহকৃত কম্বাইন হারভেস্টারকে যেমন সচল ও কার্যকর রাখতে হবে, তেমনি নতুন কম্বাইন হারভেস্টারের সরবরাহও চালু রাখতে হবে। দেশের মোট চাহিদার আনুমানিক ১৫-২০ ভাগ যন্ত্র মাঠে আছে এবং ফসলের প্রায় ২০ ভাগ যন্ত্রের মাধ্যমে কর্তন করা সম্ভব হচ্ছে। কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের ফলে ধান কর্তন, স্ট্যাকিং (স্তুপ করা), পরিবহণ, মাড়াই এবং ঝাড়াই ধাপসমূহকে কমিয়ে সংশ্লিষ্ট ধাপে ধানের অপচয় নূন্যতম ৫ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে, তার মধ্যে শুধু ধান ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন। প্রায় ২০ ভাগ যান্ত্রিক কর্তনের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ অপচয় হ্রাস বিবেচনা করা হলে শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই মোট উৎপাদিত ধানের মধ্যে ৫.৮৬ লক্ষ টন ধানের অপচয় হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে যার বাজার মূল্য (১২০০ টাকা মন হিসেবে) প্রায় এক হাজার সাতশত আটান্ন কোটি টাকা। তাছাড়া সঠিক সময়ে কর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে ফসল রক্ষা করা এবং কর্তন বাবদ টাকা সাশ্রয় করার বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য।
উল্লেখ্য, সময় মতো যন্ত্র সরবরাহের ফলে করোনা এবং করোনা পরবর্তী বোরো ও আমন মওসুমে ফসল অত্যন্ত সফলভাবে কৃষক ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য কোন অংশে কম নয়। সময়ের সাথে সাথে অনেক অংশীজন এই যন্ত্রের সাথে জড়িত হয়েছে। তাছাড়া ফসল কর্তনের ভরা মওসুমে শ্রমিকের অভাব আরও তীব্র হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। মাঠ পর্যায়ে বিদ্যমান হারভেস্টারকে সচল রাখার জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রকল্প শেষ হলে বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে মেশিন সরবরাহ প্রত্রিয়া অব্যাহত রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সমতলে ৫০ এবং হাওর ও উপকূলে ৭০ ভাগ ভর্তুকির পরিবর্তে সকল এলাকার জন্য যে কোন একটি পরিমান নির্ধারণ করা যেতে পারে। এমনকি সময়ের সাথে সাথে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে যাতে আমদানীকৃত সংশ্লিষ্ট যন্ত্রের স্পেয়ার পার্টস স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর ফলে একদিকে যেমন মাঠে সরবরাহকৃত যন্ত্রকে সচল রাখা সম্ভব হবে, অন্যদিকে সময়ের ব্যবধানে দেশে কম্বাইন হারভেস্টার তৈরির সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট,গাজীপুর।