কথায় লোকে হাতি পায়, কথায় হাতি পিষে দেয়। পা ফসকালে ঠ্যাঙ যায়, কথা ফসকালে জান যায়। আবার কথার নাম মধুরানী, যদি কথা কইতে জানি। গেল কয়েকদিন ধরে পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কথার বন্যায় প্লাবিত, সেটি সম্ভবত উপকূল রক্ষার বেরিবাঁধ ভেঙে সমগ্র কে ভাসিয়ে, ঘরের মটকা স্পর্শী পলি আর নোংরা আবর্জনায় পূর্ণ দূষিত ঘোলা জল রূপ মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথার একটি ফসল বয় অন্য কিছু নয়।
আর সমগ্র জাতিকে খোরাক জোগানো উন্নত হাইব্রিড জাতের এই ফসলটির স্থপতি হিসেবে যে নামটি সবার দৃষ্টিতে গোচর এবং কর্ণেতে পাত হচ্ছে, তিনি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের বিষ্ময় এবং পিএসসির ড্রাইভার থেকে কোটি বনে যাওয়া অষ্টম আশ্চর্য সৈয়দ টাইটেল ধারী আবেদ আলি। এখানে বলে রাখা ভালো, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ সিনেমার নায়কের মত দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তির সংখ্যাও জগতে নেহাত কম নয়। তবে আবেদ আলী সেই ক্যাটাগরিতে পরে কিনা? সেটা বোধ হয় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ এমন একটি আজব দেশ, যেখানে “খিড়কি দিয়ে হাতি চলে, সদরে বাধে ছুঁচ”। অন্যদিকে ১৬ জুলাই নিবন্ধটি যখন লিখছি তখন কোঠা সমন্বয় করে মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে স্কুল, কলেজ সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে ততখনে হয়ত এই আন্দোলনের ন্যায্য একটা সুরাহা হবে বলেও আশা রাখি। তবে চলমান আন্দোলনের ভিড়ে আবেদ আলীরা হারাবে না এবং বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে টপিকটি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হবে বলেই আমার ধারণা।
কবি ডগলাসের বিখ্যাত একটি উক্তি মনে পড়ে গেল, “পৃথিবীতে প্রত্যেকের জন্ম হয়েছে কিছু না কিছু দিয়ে যাওয়ার জন্য”। সরকারের চাকরি সাপ্লাই কারখানার ড্রাইভার আবেদ আলীও হয়তো জগতে কিছু দিয়েই যেতে চেয়েছিলেন। এবং সেটির জন্য বিদেশ থেকে আমদানির উপর নির্ভর না করে নিজ কারখানার খাসা পণ্যটিই দিয়েছেন। পণ্য যেহেতু খাসা সুতরাং তার মূল্য হিসেবে তিনিও নিয়েছেন উপযুক্ত হাদিয়া।
হ্যাঁ! এটি করে তিনি অন্যায় করেছেন। সন্দেহাতীত ভাবেই অন্যায় করেছেন। গুরুতর অন্যায় করেছেন। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছেন। কিন্তু তারা কারা? যারা দিনের আলোয় সাধু অথচ রাতের আঁধারে খদ্দের সেজে টাকার বিনিময়ে কিনেছেন আবেদ আলীর প্রোডাক্ট। সেটির উত্তম জবাবে বিদ্রোহী নজরুলের ‘পতিতার লাশ’ কবিতার এই লাইনগুলো রূপক অর্থে ব্যবহার করা যায়:-
“সাধু সুনামের ভেক ধরিয়া দেখালি দারুন খেলা,
মুখোশ তোদের খুলবে অচিরে, আসবে তোদের বেলা।
রাতের আঁধারে বেশ্যার ঘর স্বর্গ তোদের কাছে,
দিনের আলোতে চিনোনা তাহারে তাকাও নাকো লাজে।
নারী আমাদের মায়ের জাতি বেশ্যা বানালো কে?
ভদ্র সমাজে সতীর ছেলেরা খদ্দের সেজেছে।
খদ্দের সেজে ড্রাইভার আবেদ আলীকে শত কোটির পতি বানানো ভদ্র সমাজের সাধুর মুখোশধারী মানুষগুলোর দোষের পাল্লা আবেদ আলীর চেয়ে কি কোন অংশে কম? কিন্তু আগেই বলেছি এ দেশ বড় আজব ।এখানে ‘সুচ চলে না সদরে, হাতি চলে অন্দরে ‘। এখানে নীতি নয় দুর্নীতিই সংক্রামক। ঘুষ আমাদের জাতির ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূর্বপুরুষের পৈত্রিক সম্পত্তি বললেও খুব একটা ভুল হবে না।কারণ সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করতে মীরজাফর ইংরেজদের কাছ থেকে এই ঘুষই(সিংহাসন) দাবি করেছিলেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় আজও কতিপয় ব্যক্তি জ্ঞান, বিবেক ও মনুষত্ব বিসর্জন দিয়ে শিক্ষাকে কলঙ্কিত করে টাকার বিনিময়ে চাকরি নামক ‘সোনার হরিণ’ কিনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসিন।
শিক্ষা ও নৈতিক অবক্ষয়:
এখন প্রশ্ন হল আবেদ আলীর মত তাদের প্রত্যেকের মুখোশ কি উন্মোচিত হবে? টিকটিক করে এগিয়ে চলা ঘড়ির কাটায় দোয়াত রাঙিয়ে তার ব্যাখ্যা হয়তো সময় দেবে। আমি বরং শিক্ষা ও নৈতিক অবক্ষয়ের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে যৌক্তিক কিছু তত্ত্ব ও তথ্য তুলে ধরি।
মানুষ মূল্যবোধের সন্তান। এই মূল্যবোধকে জাগ্রত করে শিক্ষা। দার্শনিকদের মতে, এই শিক্ষার শতকরা ৮৫ ভাগ মানবিক এবং ১৫ ভাগ হওয়া উচিত কারিগরি। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘটছে ঠিক তার উল্টো। বস্তুবাদী দর্শনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার্থীদের বানানো হচ্ছে মানবিক গুণাবলীর অনুভূতি বর্জিত যান্ত্রিক রোবট। যেকোনো মূল্যে উঠতে হবে পদে এবং থাকতে হবে অর্থবিত্তের বিপুল বৈভবে। এটাই যেন এখন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই শিক্ষক মন্ডলীও। অন্যদিকে স্কুল কলেজের সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও বইছে বস্তুবাদের জোয়ার। এতে বস্তু জগতে উন্নতি হলেও আত্মিক দিকে তলানিতে ঠেকছে মূল্যবোধের পারদ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর মতে, “শিক্ষা হচ্ছে পিরামিডের মত যার উচ্চচূড়ায় রয়েছে উচ্চ শিক্ষা”। কিন্তু শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে মূল্যবোধ ও মানবিকতার ঘাটতি হলে দেখা দেয় সামাজিক অবক্ষয়। যার ফলস্বরূপ সহপাঠীর হাতে খুন হয় সহপাঠী, ডাক্তারি বিদ্যায় পড়ুয়া ছাত্রের কক্ষ হয় মাদকের আখড়াবাড়ি, পর্নোগ্রাফির পণ্যে পরিণত হয় সহপাঠী বোন, আর মেধার চর্চা ব্যাতি রেখে ঘুষের চর্চায় প্রশ্ন বাগিয়ে কেনা হয় চাকরির আসন।
অন্যদিকে মেঘের বৃষ্টি, আগুনের দহন, কিংবা শৈত্যের হিমতার ন্যায় স্বতঃসিদ্ধ নিয়মেই উল্লেখিত অনৈতিকতা ও অমানবিকতার চর্চা জন্ম দেয় অযাচিত, অবাঞ্ছিত আগাছা রূপ আবেদ আলীদের। আর আগাছার কাজ কখনো ফুল ফোটানো নয়। উপরন্ত হুল ফোটানো। আবেদও তাই সগত্রীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। কিন্তু সবার আগে মনে রাখা উচিত আমরা মানুষ। সৃষ্টির সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণী। আর এই প্রাণীর কাজ কেবল নিজের ভালোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং চারপাশের সবাইকে ভালো থাকতে সহায়তা করার মাঝে রয়েছে সর্বোৎকৃষ্ট জীবের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা।
বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন,”আদর্শ জীবন হচ্ছে সেটি, যেটি প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও জবার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন,”আদর্শ জীবন হচ্ছে সেটি, যেটি প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত”
এই জ্ঞানের রয়েছে তিনটি শর্ত। Justify, true, belief(বিচার, বৈধতা/ সত্যতা, বিশ্বাস)। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার বিচারে, ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বে যেটি সত্য, ন্যায় ও ভালো কেবলমাত্র সেটিকেই জ্ঞান বলা যায় এবং বিচার করে সেটিই গ্রহণ করো অন্যথায় নয়।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আবেদ আলীর প্রশ্ন বিক্রি ও চাকরি প্রার্থীদের ক্রয়। সেটির আগে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেয়া যাক:-
✓মাছির ছয়টি পা এবং পাঁচটি চোখ থাকে। এক জোড়া যৌগিক সাধারণ চক্ষু এবং ত্রিভুজের মতো তিন দিকে তিনটি ছোট চক্ষু। এই চক্ষুর সাহায্যে মাছি ৩৬০°(ডিগ্রী) কোণে চতুর্দিকে দেখতে পায়।
✓চতুষ্পদী প্রাণী হাতি, ঘোড়া, গরু, ছাগল প্রভৃতির চক্ষু দুটি এবং এগুলো মুখমন্ডলের দুই পাশে অবস্থিত। তাই চতুষ্পদী প্রাণী ৩০০°(ডিগ্রী) কোণে একাধারে সামনে ও দুইপাশের বস্তু দেখতে পায়।
✓অন্যদিকে দ্বিপদী-প্রাণী মানুষের চক্ষু মুখমন্ডলের সামনে অবস্থিত। যে কারণে মানুষ ১৮০°(ডিগ্রী) কোণে কেবলমাত্র তার সামনে থাকা বস্তুই দেখতে পায়।
এখন আমি স্কুল জীবনের পরীক্ষাগুলো থেকে পাওয়া চোখের তিন ধরনের ব্যবহারের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরবো:-
✓এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল যারা প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার সাথে সাথে সেটিতে ঢু মেরে দুচোখ খাতায় নিবদ্ধ করে লেখা শুরু করতো। এবং শেষ ঘন্টা না পরা অবধি খাতা থেকে চক্ষু সরাত না।
✓দ্বিতীয় আরেক শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাদের দৃষ্টি প্রশ্নপত্র, খাতা এবং একই সাথে তার আশপাশে নিক্ষেপ করে। এবং আশপাশে তার এই দৃষ্টি নিক্ষেপের কাজ পালাক্রমে চলত শেষ ঘন্টা অবধি।
✓তৃতীয় আরেক শ্রেণীর শিক্ষার্থী যারা কেবল সামনে এবং আশপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ক্ষ্যান্ত দিতেন না। একই সাথে পেছনে এবং বাসা থেকে বিশেষ জায়গায় সযতনে লুকিয়ে আনা বিশেষ বস্তুতেও সমানতালে থাকতো তাদের দৃষ্টির সচেতন আনাগোনা। এবং বলায় যায়, তাদের এই মহতী কাণ্ড চলত শেষ ঘন্টা এমনকি উত্তরপত্র পরীক্ষকের হাতে জমা না নেওয়া অবধি।
এখানে বলে রাখি, এই শ্রেণীর শিক্ষার্থীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এতই প্রখর যে, প্রশ্নপত্রে কি আসতে পারে তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুমান করতে পারতেন। অর্থাৎ এদের সর্বদ্রষ্টা বলা যায়।
বিশ্লেষনে দেখা যায় (রূপক অর্থে), প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী একটি দোপায়া প্রাণী যার চক্ষু মুখমন্ডলের সামনে এবং দৃষ্টিসীমা ১৮০° (ডিগ্রী)। এবং বাকি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীর দৃষ্টিসীমা (রূপক অর্থে) যথাক্রমে ৩০০°( ডিগ্রী) এবং ৩৬০°( ডিগ্রী)। এবং তাদের ওই শ্রেণী ভুক্ত প্রাণী বলা যায় (রূপক অর্থে)।
সুতরাং পাঠকগণ বুঝতেই পারছেন কোন শ্রেণীর প্রাণী(পরীক্ষার্থী) প্রশ্নপত্র ক্রয় করে উত্তর মুখস্থ করে সেটি খাতায় উপস্থাপনের মাধ্যমে চাকরি ক্রয় করে। একই সাথে তাদের দৃষ্টির পরিসীমায় বা কত? তাই শৈশবে “মাছি মারা কেরানি” কথাটির অর্থ না বুঝলেও এখন “মাছি মার্কা কেরানি” কথাটির অর্থ ঠিকই বোঝা যায়।
এখন কথা হল তাহলে কে শ্রেষ্ঠ? ৩৬০° (ডিগ্রীর ছ’পেয়ো মাছি নাকি ১৮০°( ডিগ্রীর) দো’পায়া মানুষ। আর মানুষের দৃষ্টিসীমা ১৮০°(ডিগ্রী) দিয়ে সৃষ্টির রহস্যই বা কি? খুব সাধারন, স্রষ্ট মানুষকে ১৮০°(ডিগ্রী) দৃষ্টিসীমা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কারণ মানুষ শুধু সামনে দেখবে এবং প্রগতির দিকে যাবে।
কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনের প্রগতির ধারা উল্টিয়ে ১৮০°(ডিগ্রীর) সম্মুখ দৃষ্টি সীমার দো’পায়া মানুষ যখন ৩০০°(ডিগ্রীর) চতুষ্পদ কিংবা আরো একধাপ পিছিয়ে ৩৬০°(ডিগ্রীর) ছ’পেয়ো প্রাণীর কর্ম করে তখন সমাজ অনিয়ম দুর্নীতি আর স্বার্থপরতার ভোগ বিলাসে মত্ত হয়। আর এরই ফাঁকফোকরে বনজ উদ্ভিদের মতো সবার অগোচরে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আবেদ আলীরা।
কিন্তু একবারের জন্যেও কি আমরা ভেবে দেখেছি, সার্থকতা কিসে? ভেবেছি কি মহত্ত্ব কিসে? বিপুল বৈভব ভোগে, নাকি পরহিত ত্যাগে? গেয়র্গ হেগেল বলেছেন,“Be a person ,die to live”-মানুষ হও মরে বাঁচ। অর্থাৎ নিঃস্বার্থ পরহীত কর্ম মানুষকে মহান জীবন দান করে। মরলেও সে হয় অমর।
তাই ন্যায়-নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে মেধাবীকে বঞ্চিত করে মেধাহীনতার স্বীকৃতি দানের অভিশপ্ত প্রথা সমাজ থেকে নির্বাসিত হোক চিরতরে। শিক্ষার পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ুক মানবিকতার নির্যাস। ৩৬০ থেকে মানুষ ফিরুক তার স স্থান ১৮০ তে। সমাজ হোক মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা -শান্তি ও প্রগতির।
শেষ করব জন ডি. রগফেলার এর একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি বলেছেন,”আমি শূন্য মস্তিষ্ক চাই না, চাই খোলা মস্তিষ্ক। শূন্য হৃদয় না, চাই উন্মুক্ত হৃদয়”।
লেখক: বিজয় সরকার, কলামিষ্ট