বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি একসময় স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূলে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য, যে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, আজ সেই ছাত্র রাজনীতি বিভিন্ন সংঘর্ষ ও সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার পরিবেশকে বিষাক্ত করছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার গৌরবময় ছাত্র রাজনীতি থেকে বর্তমান সহিংসতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানের দলীয় রাজনীতি সেই গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের জন্য ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং কখনো কখনো সহিংসতার পথ বেছে নেয়, যা শিক্ষার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ও গণ রুম সংস্কৃতি
বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ছাত্র রাজনীতির সহিংসতার এক চরম দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে আবরারকে তার সহপাঠীদের দ্বারা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড গণ রুম সংস্কৃতির নামে ভয় ও সন্ত্রাসের চিত্রটি প্রকাশ করে, যা দলীয় ছাত্র রাজনীতির নামে পরিচালিত হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি ও সহিংসতার ঘটনা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে বিভিন্ন সহিংস ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে ২০১৪ সালে তরিকুল ইসলাম নামের একজন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হন। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার পরিবেশকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের ওপর নিপীড়ন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির নামে নারীদের মানসিক ও শারীরিক হয়রানি করা হয়। শিক্ষাঙ্গনে নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে দলীয় প্রভাবের কারণে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ প্রভাব
১. সহিংসতা ও ভীতি: ক্ষমতার লড়াইয়ে শিক্ষার্থীরা সহিংসতার শিকার হয়, যা তাদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত করে।
২. শিক্ষার পরিবেশের ধ্বংস : দলীয় রাজনীতির প্রভাবে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না এবং শিক্ষার মান অবনতি ঘটে।
৩. স্বাধীন মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা*: ভিন্নমতের কারণে শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হয়, যা স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের উচিত শিক্ষাঙ্গনে তাদের প্রভাব বিস্তার না করা। দলীয় রাজনীতি বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের মুক্তমনে শিক্ষাগ্রহণ ও মানসিক বিকাশের সুযোগ প্রদান করা উচিত।
শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে একটি সুশৃঙ্খল ও শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে ছাত্র রাজনীতির সহিংস প্রভাব দূর করতে হবে। একটি নিরাপদ, স্বাধীন এবং শিক্ষামুখী পরিবেশ নিশ্চিত করাই পারে জাতির উন্নয়নের পথে সত্যিকার অর্থে অবদান রাখতে।