পর্দার আড়ালের নায়ক, আঁধার রাতের ধ্রুব তারা কিংবা অন্ধের যষ্টি যাই বলি না কেনো তাকে বিশেষায়িত করতে সকল উপমাই ব্যর্থ। তিনি সর্ব জয়ী ফুটবল কোচ লিনেল সেবাস্তিয়ান স্কালোনি।আলবিসেলেস্তে জার্সির তিন তারার তিন নায়ক লুইস মেনোত্তি, কার্লোস বিলার্দো এবং লিওনেল স্কালোনি। ১৯৭৮ এ মেনোত্তি, ১৯৮৬ তে বিলার্দো আর ২০২২- এ স্কালোনি ই ছিল বিশ্বজয়ে আর্জেন্টিনার চিত্রনাট্যের পরিচালক। এই ছোট্ট তালিকার মাঝেও সবচেয়ে অনন্য স্কালোনি।
“লিওনেল স্কালোনির” কোচিং ক্যারিয়ারের অভিষেকটা ১১ই অক্টোবর ২০১৬ তে। ততকালীন স্বদেশী আর্জেন্টাইন কোচ ‘হোর্হে সাম্পাওলির’ এস্ট্যান্ট হিসেবে সেভিয়াতে যোগ দেন তিনি। ২০১৭ তে সেই সাম্পাওলির হাত ধরেই রাশিয়া বিশ্বকাপে অনেকটা অনিশ্চিত আর্জেন্টিনা দলের এসিস্ট্যান্ট কোচ হিসেবে দলে যোগ দেন স্কালোনি।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ভরাডুবির পর চাকরিচ্যুত হন ‘হোর্হে সাম্পাওলি’। ছন্নছাড়া AFA তখন দারস্থ হন দুনিয়া মাতানো আর্জেন্টাইন কোচ ডিয়াগো সিমিওনে, মারিসিও পচেত্তিনো, মার্সেলো গ্যালার্দো’দের।
একে একে সবার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকা আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশন দায়িত্ব তুলে দেন পাবলো আইমার ও লিওনেল স্কালোনির কাধে। অবশ্য এর পাশাপাশি ‘ আর্জেন্টিনা অনূর্ধ-২০’ দলেও হেড কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ‘স্কালোনি’।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রধান কোচ হিসেবে নির্বাচিত হন ‘স্কালোনি’। অভাগা তাকালে সাগরও শুকিয়ে যায় ঠিক তেমনি স্কালোনির দায়িত্ব নেয়ার সময় আর্জেন্টিনা জাতীয় দল ও ফুটবলের মহাতারকা মেসি পার করছিলেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। মেসি যখন নিজেকে হাড়িয়ে খুজছেন ঠিক তখনই উত্তরণের পথ খোজা শুরু করেন ফুটবল মাস্টার মাইন্ড স্কালোনি। বিধিবাম উলটো এই সিদ্ধান্তের পর পরই নানা ধরনের বিতর্ক শুরু হয়ে আর্জেন্টিনা বোর্ড এবং স্কালোনিকে ঘিরে। প্রয়াত ফুটবল কিংবদন্তী “দিয়াগো ম্যারাডোনা” অনেকটা ঠাট্টা করেই বলেছিলেন-
“স্কালোনি একজন অযোগ্য, অনভিজ্ঞ ব্যাক্তি।তিনি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতে পারবেন, কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু সেটি মোটরস্পোর্টসের বিশ্বকাপ, ফুটবল বিশ্বকাপ নয়”!
২০১৯ এর কোপা আমেরিকাতে ৩য় স্থান অধিকার করে আর্জেন্টিনা দল। তার উপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছেই ২-০ গোলের ব্যবধানে হেরে আসর থেকে বিদায় নেয় স্কালোনি বাহিনী। প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য না আশায় হতাশ হন অনেকেই। সমালোচনার তীরে বিধ্বস্ত হয় স্কালোনি ও তার দল।
স্কালোনির পদত্যাগের দাবীতে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। তবুও আস্থা হারায়নি আর্জেন্টিনা বোর্ড। সমালোচনাকে পেছনে ফেলে স্কালোনির সাথে ২০২২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ হয় আর্জেন্টিনা ফুটবল এসোসিয়েশন।
নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরেই নিজের জাত চেনাতে থাকেন স্কালোনি। ম্যাচ এনালাইসিস, ট্যাকটিক্স,প্লেয়ার সিলেকশনসহ সর্বক্ষেত্রে নিজের সেরাটা ঢেলে দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের আগাম জানান দেন তিনি। ধৈর্য্যের সাথে বিধ্বস্ত,হতাশাগ্রস্ত টিম আর্জেন্টিনাকে তিলে তিলে গড়ে তুললেন শক্তিশালী দল হিসেবেযার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ছিলেন “লিওনেল মেসি”। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরি দুর্দান্ত এক টিম কম্বিনেশন গড়ে ওঠা দলটা ফলাফল পেতে মোটেও কালক্ষেপণ করেন নি।
২০২১ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনাকে দীর্ঘ ২৮ বছর পর কোন আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। যার মূল কান্ডারী ছিলেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। জাতীয় দলে অধরা আন্তর্জাতিক শিরোপা ছুঁতে না পারা মেসির সাফল্যও আসে স্কালোনির হাত ধরে। তিনি জিতে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা।
দ্বিতীয় শিরোপা জয় করতে মোটেও সময় নেন নি স্কালোনি। ২০২২ সালের পহেলা জুনে ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইটালিকে বিধ্বস্ত করে ৩-০ গোলের জয় তুলে নেন স্কালোনি বাহিনী। তাছাড়া আর্জেন্টিনা ফুটবল ইতিহাসে প্রথম টানা ৩৬ ম্যাচ আনবিটেন বা অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে পা রাখেন স্কালোনির আর্জেন্টিনা।
নাটকিয়তার কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। স্কালোনির দল হট ফেভারিট। কিন্তু শিরোপা যে এত সহজে ধরা দেয়ার বস্তু নয়। বিজয় যে ছিনিয়ে নিতে হয়। উড়তে থাকা স্কালোনির আর্জেন্টিনা কে মাটিতে নামিয়ে দেয় ‘সৌদি আরব’। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ‘সৌদি আরবের’ সাথে ২-১ গোলের অপ্রত্যাশিত পরাজয় বরণ করে আর্জেন্টিনা। ভেঙে যায় ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে জাগে শঙ্কা! গ্রুপ পর্ব পেরোতে পারবে তো আর্জেন্টিনা!!!
স্কালোনি যেন কবি নজরুর বিদ্রোহী কবিতার সেই বিদ্রোহী। করে শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। যে হেরে যাওয়ার আগে হারে না। ভেতরে সামান্য জীবনীশক্তি থাকতে মরে না। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচেই আবারো স্বরুপ ফিরে পায় স্কালোনির আর্জেন্টিনা। ডিফেন্স ঠিক রেখে কাউন্টার এট্যাক ভিত্তিক আক্রম সাজিয়ে খুব সহজেই ‘ম্যাক্সিকোর’ বিরুদ্ধে ২-০ গোলের জয় তুলে নেয় আর্জেন্টিনা। নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে আবারো নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন স্কালোনি। প্রেস ও উইং নির্ভর ফুটবল খেলে ‘পোল্যান্ডকে’ ২-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিনে’ পা দেয় আর্জেন্টিনা। সাথে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসও ফিরে পায় দল।
রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ‘অস্ট্রেলিয়াকে’ ২-১ গোলে ও কোয়ার্টার ফাইনালের প্যানাল্টি শুট আউটে নেদারল্যান্ডসেকে ৪-৩ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালে ‘ক্রোয়েশিয়াকে’ ৩-০ গোলে রীতিমতো উড়িয়ে দেয় স্কালোনির মেসি বাহিনী।
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনা ১০৮টা নীলপদ্ম নিয়ে বরুনা কথা না রাখলেও কথা রেখেছেন স্কালোনি। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ‘ফ্রান্সকে’ পেনাল্টি শুট আউটে ৪-২ গোলে হারিয়ে ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় টিম আর্জেন্টিনা।নিজেদের ইতিহাসে ৩য় বিশ্বকাপ জয় করে দলটি যার নেপথ্যের কারিগর “লিওনেল স্কালোনি”।
স্কালোনি শুধু ফলই দেয় নি বিশ্ব ফুটবল কে দিয়েছেন একঝাঁক বিশ্বমানের ফুটবলার। তার ধরেই বিশ্বফুটলে রাজত্ব করছেন ক্রিস্টিয়ান রমেরো, লিসান্দ্রো মার্তিনেজ, ম্যাক এলিষ্টার, এঞ্জো ফার্নানদেজ ও হুলিয়ান আলভারেজ সহ প্রমুখ ফুটবলার। তবে স্কালোনির কর্মের যথেষ্ট মূল্যায়নও পেয়েছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ফুটবল ইতিহাস ও পরিসংখ্যান ফেডারেশন তথা (IFFHS) দ্বারা ২০২২ সালের সেরা ম্যান’স কোচ হিসেবে বিবেচিত হন এই মাস্টারমাইন্ড। তাছাড়া ২০২২ -এর সেরা ফিফা ম্যান’স (FIFA BEST) কোচ হিসেবেও সম্মানিত হয়েছেন।
কাতার বিশ্বকাপ জয়ের প্রায় এক বছর পর, গত ২১শে নভেম্বর ২০২৩ এ আর্জেন্টিনা ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের। ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে ১-০ গোলে ব্রাজিলকে হাড়িয়ে ইতিহাস গড়ে স্কালোনির দল। ইতিহাসের প্রথম বার ব্রাজিল ঘড়ের মাঠে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে হারের স্বাদ গ্রহণ করে। [বি:দ্র:এটি ছিলো আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ৫ম ম্যাচ] তবে জয়ের আনন্দ দীর্ঘায়িত হয়নি ভক্তদের জন্য। ম্যাচ শেষে স্কালোনি ঘোষণা দেন তিনি আর বেশিদিন থাকছেন না দলের সাথে। আর্জেন্টিনা সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায় ২০২৪ এর কোপা আমেরিকা দিয়েই আর্জেন্টিনার সাথে সম্পর্কের ইতি টানবেন এই মাস্টার মাইন্ড।
২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুতে নানা সমালোচনার স্বীকার হন এই আর্জেন্টাইন কোচ। অথচ তা সত্যেও কখনো এই সংক্রান্ত বিষয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেননি স্কালোনি। সকল সমালোচনার জবাব দিয়েছেন মাঠেই। স্কালোনি সেই সকল নিন্দুকদের আজ তার ফ্যান হতে বাধ্য করেছেন।মুগ্ধ করেছেন বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল প্রেমিকে। আর্জেন্টাইন ফ্যানরা তাকে নিয়ে গর্ব করতেই পারে। ঘুমাতে যেতে পারে নিশ্চিন্তে, কারণ আর্জেন্টিনার একজন স্কালোনি আছেন।