খুলনা শহরের সাতরাস্তার মোড়ে প্রতিদিন সকালে হাটের মতো দারাদরি করে বিক্রি হয় মানুষের শ্রম। টাকার বিনিময়ে এক দিনের শ্রম বিক্রি করতে সেখানে জড়ো হন শতাধিক মানুষ।
শনিবার সকালে মানুষ বিক্রির সেই হাটে একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় মিরর অফ বাংদেশের। শ্রমিকরা জানান, বাজারে এখন সব কিছুর দাম বাড়লেও শুধু তাদের শ্রমের মূল্য বাড়েনি, বরং কমছে।
প্রতিদিনের মতো এই বাজারে শ্রম বিক্রি করতে হাজির হয়েছেন শহরের দোলখোলা এলাকার আবু বকর সিদ্দিক। তিনি জানান, বর্তমানে তারা দৈনিক ৪৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে সারা দিনের শ্রম বিক্রি করছেন। অথচ এক মাস আগেও তারা ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হতেন।
আবু বকর বলেন, ‘এখন এক দিন কাজ পেলে, বাকি দুই দিন কোনো কাজ পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে কম মজুরিতে কেউ ডাকলেও চলে যাচ্ছি।’
ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, এক মাস ধরে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। চাল, আটা, ময়দা, ডিম ও বয়লার মুরগি ছাড়াও তেল ও গরুর মাংসের দাম অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। একই পরিস্থিতি সবজি ও মাছের বাজারেও।
একদিকে শ্রমের দাম কমে আসা, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দৈনিক মজুরির শ্রমিকরা।
ওই হাটে আসা শহরের রায়পাড়া এলাকার শ্রমিক জালাল উদ্দীন বলেন, ‘পরিবারের পাঁচজনের ভরণপোষণ চলে আমার একার আয়ে। কিন্তু আজকাল প্রতিদিন কাজ মিলছে না। অন্যদিকে মজুরিও কমে গেছে। তাই সংসার চালানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে।’
জালাল জানান, গত এক মাসে তিনি আয় করতে পেরেছেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। দৈনিকের আয় থেকে প্রতিদিন তাই দেড় শ টাকা তাকে ঘর ভাড়ার জন্য রেখে দিতে হয়। বাকি ৩০০ টাকার বাজারে পাঁচজনের সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর বাইরে কারেন্ট বিলসহ আছে অন্যান্য খরচও। সাংসার চলছে তাই ধারদেনা করে।
জালাল বলেন, ‘কোনো দিন কাজ না পেলে চিন্তা আরও বেড়ে যায়। তাই কম টাকায়ও শ্রম বিক্রি করে দিচ্ছি।’
শহরের রায়পাড়া থেকে আসা শ্রমিক আজিজুল বলেন, ‘আমার চারজনের সংসার। এর মধ্যে দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। এখন যে আয় হচ্ছে, তাতে সংসারই চালাতে পারছি না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে খুবই মুশকিলে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশে সব কিছুরই দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মজুরি হঠাৎ কেন কমে গেল তা বুঝতে পারছি না। আমরা বাড়তি মজুরি চাইলে অনেকে পাঁচজনের কাজ তিনজন দিয়ে করাতে চাচ্ছেন। তাই অনেক শ্রমিক প্রতিদিন কাজও পাচ্ছেন না।’
ইউসুফ আলী নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘সারা দেশে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলেই বিপদে পড়ি আমরা। আগে করোনার সময়ও সমস্যায় ছিলাম। তখন অনেকে আমাদের সহায়তা করেছেন। এখন কেউ সহায়তাও করছেন না। আবার কাজে নিতেও চাচ্ছেন না।’
শ্রম বিক্রির এই হাটে শ্রমিকদের দৈনিক চুক্তিতে কাজে নেন মূলত খুলনা শহরের বাড়িওয়ালারা। কেউ নেন নির্মাণাধীন ভবনের কাজে, কেউ আবার মাটি কাটাতে, রং করাতে, বাড়ির ড্রেন, ছাদ, সিঁড়ি, ঘরের মেঝে কিংবা পানির ট্যাংকি পরিষ্কার করাতে। বাসা পরিবর্তন করতেও এসব শ্রমিকের দ্বারস্থ হন অনেকে।
ওই হাটে দেখা গেছে, যারা শ্রমিকদের কিনতে আসছেন, তারও বেশ বিপাকে পড়ছেন। কেউ হয়তো একজন শ্রমিককে নিতে এসেছেন; কিন্তু ১০-১২ জন গিয়ে কাজে নেয়ার আকুতি জানাচ্ছেন।
দুজন শ্রমিক নিতে আসা মিস্ত্রিপাড়ার মাইনুর গাজী বলেন, ‘আমার বাড়ির সিঁড়ি পরিষ্কার করাতে দুজনকে ১ হাজার টাকায় ঠিক করেছি।’
তিনি আরও বলেন, সব কিছুর দাম অসহনীয় পর্যায়ে। তাই যেখান থেকে যা পারছি, কম দামে নেয়ার চেষ্টা করছি।’