গত বছরের নভেম্বরে অটোরিকশার ধাক্কায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী রাচির মৃত্যুর ঘটনায় আটক রিকশাচালককে নির্দোষ দাবি করেছে পরিবার। রাচির মৃত্যুর ঘটনায় রিকশাচালক তো জড়িত ছিলেনই না, বরং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফাঁসিয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) এক সাক্ষাৎকারে আটক ওই রিকশাচালকের পরিবার এই দাবি করেন।
প্রাথমিকভাবে সেই রিকশাচালকের মেয়ে আরজিনা আক্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফেসবুক গ্রুপে ঘটনার বিস্তারিত লিখে পোস্ট করেন এবং পরবর্তীতে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে একটি লাইভ করেন যেখানে তিনি নিজের বাবাকে নির্দোষ দাবি করেন এবং প্রশাসনের প্রতি অবিচার ও জুলুম করার অভিযোগ তুলেন।
পরবর্তীতে তার সাথে সরেজমিনে দেখা করতে গেলে তিনি দাবি করেন, তার বাবা একজন টেইলারিং কাটিং মাস্টার। এর পাশাপাশি তিনি পুরাতন অটোরিকশা ক্রয় করে সেটাকে রং করে, সংযোজন-বিয়োজন করে লাভে বিক্রি করেন। এছাড়াও যেদিন জাবি শিক্ষার্থী রাচি রিকশার ধাক্কায় নিহত হয় সেদিন রিকশাচালক সেখানে ছিলেন না বলে দাবি করেন আরজিনা।
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় আরজিনা মিরর অফ বাংলাদেশকে জানায়, এই ঘটনার তদন্তে ২৩ নভেম্বর আনুমানিক দুপুর ১ টার দিকে একজন ব্যক্তি আমার বাবাকে ফোন করে প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে সকল সাক্ষীদের সামনে আমার বাবাকে বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করে আনুমানিক বিকাল ৪ টার দিকে আমার বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। একইদিন রাত ১০ টার দিক আমার বাবা এবং আমাদের ড্রাইভার রফিকুল এক সাথে বসে রাতের খাবার মুখে দিবে সেই সময় আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা না করে আনুমানিক ১০/১৫ জন লোক আমাদের ঘরে প্রবেশ করে এবং জিজ্ঞেস করে তোমাদের মধ্যে রফিকুল কে? তোমাকে ফোন দেই ফোন ধরো না কেন? তাদের প্রশ্নের জবাবে রফিকুল বলে, ‘স্যার আমার ফোনে কোন কল আসেনি। আমি রফিকুল। আপনি চেক করতে পারেন আমার ফোন।’
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে তারা আবার সেই নাম্বারে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হয় যে তারা যে মানুষকে খুঁজছে আসলে এটা সেই রফিকুল না। ওই নাম্বারের রফিকুলের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তারপর তারা আমাদের ঘরের কালো রঙের হুডি এবং কালো মধ্যে লাল চেকের ট্রাউজার খোঁজার জন্য সকল কাপড় এবং জিনিস উলটপালট করে। কিন্তু তারা কোন কিছুই পায়নি। আমি বাবা হুডি পরে না। একপর্যায়ে আমার বাবাকে দুর্ঘটনার দিন কোথায় কোথায় ছিল সেটা জানার জন্য ইসলামনগর বাজার সংলগ্ন ইন্জিনিয়ারিং মার্কেট কামরুলের দোকান এবং শাহাদাত এর দোকান নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা প্রথমে সেখানে না নিয়ে প্রথমে প্রক্টর অফিসে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসা করে এবং পরবর্তীতে তারা ইসলামনগর বাজার সংলগ্ন ইন্জিনিয়ারিং মার্কেট যায় সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।
এদিকে ঘটনার সময় তার বাবা কামরুলের দোকানে বসে ছিলেন এমনটা দাবি করে তিনি বলেন এর সিসিটিভি ফুটেজ তারা দেখে। কিন্তু এই ফুটেজ তারা সাথে করে মেমোরি কার্ডসহ নিয়ে আসে। ঘটনার সময় তার বাবা ক্যাম্পাসে ছিল না, এর সত্যতা জানার পর রাত আনুমানিক ৩ টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পরদিন রাত ১১ টার দিক আরজিনার বাবার ফোনে একটা ফোন আসে যেখানে তিনি যার কাছে রিকশা বিক্রি করেছিল তাকে ও রিকশাটি দেখতে চাওয়ার কথা বলা হয়। পরে তার বাবা রিকশাসহ মালিককে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসে। আরজিনার পিতা যে রিকশা বিক্রি করেছিল সেটি দুর্ঘটনার ২ দিন পূর্বে বিক্রি করা হয়েছিল। তবে সেই লোকটা হয়তো ভয়ে বলেছিল তার বাবা রিকশা দুর্ঘটনার ২ দিন পর বিক্রি করেছে। আর ওই রিকশা বিক্রি করার কয়েকদিন পর রিকশার কাগজ করে দেওয়া হয়।
আরজিনা বলেন, আমরা জানি ২৪ তারিখ দিবাগত রাতে আমার বাবাকে রিকশা দেখানোর জন্য ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে শুনি আমার বাবার নামে অজ্ঞাতনামা মামলা হয়েছে। এমনকি তারপর দিন সকালেই কোর্টে তোলা হয়েছে। এই মামলায় বলা হয়েছে আসামির অটোরিকশায় আবুল হায়াত ও নাহিদ আলী নামের ২ জন যাত্রী ছিলেন। এছাড়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা রফিকুল উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমরা ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কি সত্যি সেই দিন আরজু মিয়াকে দেখেছিলেন? তখন ঝালমুড়ি বিক্রেতা বলেছিলেন, ‘না আমি দেখিনি তবে আমাকেও ফাঁসানো হয়েছে সাক্ষী দেওয়ার জন্য।’
রিকশাচালক পরিবারের দাবি, যখন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তখন আনুমানিক ৬ টা ৫০। অর্থাৎ সেসময় অনেক অন্ধকার ছিল যেহেতু তখন শীতকাল। রিকশাচালক লোকটা কালো হুডি পরা ছিল বলে তারা জেনেছেন। ক্যাম্পাসে লাইটিং ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। আর দুর্ঘটনার পর রিকশা যদি দাড়াইতো, তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেত।
তার পরিবার প্রশ্ন রেখে বলেন, দুর্ঘটনার পর ওই ২ যাত্রী তখন কেন চালককে আটকালো না? আর তারা যদি ওই রিকশায় থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই চালকের চেহারা স্পষ্ট ভাবে দেখেছে। তাহলে আগেই কেন আরজু মিয়াকে শনাক্ত করতে পারলো না? দুইবার যখন আরজু মিয়াকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তো তাকে কেন শনাক্ত করতে পারলো না। কিন্তু যেদিন গ্রেফতার করা হলো সেদিন কীভাবে তাকে শনাক্ত করলো আর দোষী সাব্যস্ত করলো?
আটক রিকশাচালক আরজু মিয়ার স্ত্রী বলেন, আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। আমরা শক্তিশালী নই বলে আমাদের সাথে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েকবার ভিসি স্যারের দপ্তরে গিয়েছি। আমাদের সাথে দেখা করেননি। একজনের কাছে গেছে আরেকজনের কাছে যেতে বলে। এভাবে গত তিনমাসে অনেক দপ্তর ঘুরেছি। আমার স্বামী খুবই অসুস্থ। আমি তার মুক্তি চাই। আমাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি এমন অভিযোগ কেনো করলো এবং এর সত্যতা কতটুকু এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম ফোনালাপে জানায়, “আমি এ ব্যাপারে এখনো অবগত নই। তবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানতে চাইলে আমাদের অফিস টাইমে এসে সশরীরে দেখা করতে হবে।”
সোহাগ/মিরর