অনেকে একুশ ও ছত্রিশের মিল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন। মিল খুঁজতে যাওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। কারণ একুশ ও ছত্রিশ একই লাটাইয়ে বাঁধা সুতোয় মুক্ত আকাশে স্বাধীনতাভাবে উড়ন্ত ঘুড়ি, অবিভাজ্য সম্পর্কের মেলবন্ধনে আবদ্ধ দুই প্রজন্ম। যাদের দেশপ্রেম নামক অমোঘ নেশায় বুদ হয়ে ইতিহাসের পাতায় সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটি।
ছোটবেলায় দেখতাম গাছে কলম করে একই গাছে দুইরকম বরই উৎপাদন করা হতো। ঠিক তেমনি একুশের মূলে উজ্জীবিত বৃক্ষের কলমকৃত অংশটি হলো ছত্রিশ। বহিরাবরণ ভিন্ন হলেও মূল চেতনার অংশটি একই। একটি মাতৃভাষা পুনরুদ্ধারে এবং অপরটি বাকস্বাধীনতা সহ অধিকার আদায়ের। আর ৭১ হলো আমাদের ভূখন্ডকে রক্ষা করার লড়াই, দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াই। এজন্য ৫২, ৭১ এবং ২৪ একই সুতোয় গাঁথা মুক্তোর মালা। মুখ, মুক্তি, মুক্ত এই তিনের সমন্বিত হয়ে উঠার পেছনের ইতিহাস অবশ্য অনেক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়বস্তু। সে হিসাবে পঠিত আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করাই সমীচীন হবে বলে মনে করি।
ছুটে চলা গাড়ির গতিবেগ নির্ধারিত হয় সামনে আগত বিষয়বস্তুর উপর বিবেচনা করে। ঠিক তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে উঠে অন্যায়ের মাপকাঠির উপরে। কারো মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া যেমন অন্যায় আবদারগুলোর মধ্যে চরম, ঠিক তেমনি দীর্ঘদিন ধরে বাকস্বাধীনতা হরণ করে রাখাও মারাত্মক অন্যায়। বঞ্চিত জনগোষ্ঠী একসময়ে সমষ্টিগতভাবে বুলি আওড়ানোর মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অন্যায় কিছু চাপিয়ে দিয়ে কিংবা অন্যায়কে হালাল হিসাবে উপস্থাপন করার ভুলপথ যুগে যুগে যারাই অবলম্বন করেছে তাদের পরাজয় একসময় সুনিশ্চিত। সেটা হোক ১৯৫২, ১৯৭১ কিংবা সদ্য ২০২৪। পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যায় আবদারের মুখে রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করেছিলো সালাম, রফিক, বরকত। আর ফ্যাসিস্ট বাহিনীর থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জীবন দিয়েছে আবু সাইদ, মুগ্ধ, রিয়া গোপ সহ অসংখ্য মানুষ। একটি ঘটেছিলো ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আর অপরটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই)। অন্যায় কিছু যখনই ঘটেছে কিংবা অন্যায়ের পাহাড় গড়ে উঠেছে তখনই এই মাতৃভূমির দামাল সন্তানেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এটা সম্ভবত এই মাতৃভূমির মাটির অনন্য গুণ। নাহলে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার নজির যেখানে পৃথিবীর আর কোথাও নাই সেখানে এই ভূমির অদম্য উচ্ছাসে আলোড়িত তরুণেরা প্রাণ দিয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে। আবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করতেও নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে এসময়ের নতুন প্রজন্ম।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সফরে এসে তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সেদিন ‘নো নো’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছিল এদেশের ছাত্রযুবকেরা। এরপর নানা সংগ্রাম আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রয়ারি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। ঠিক একইরূপে ১৪ জুলাই ২০২৪ পতিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। তিনি দেশের আপামর জনতাকে ‘রাজাকার’ হিসাবে অভিহিত করেন পারতপক্ষে। পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা এই তকমার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরবর্তীতে আপামর ছাত-জনতা এই আন্দোলনে যোগদান করেন। ফলস্বরূপ মাত্র ২০ দিনের মাথায় পতন ঘটে দীর্ঘ ১৬ বছরের এক ফ্যাসিস্ট শাসনামলের।
একুশ আমাদের মুক্তির চেতনা। একুশের চেতনা আমাদের মনের চেতনা। ছত্রিশের চেতনা তারই পাদদেশে উঁকি দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি সামরিক যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পরিণতি। যে সংগ্রামের ভিত্তি গড়ে ছিল ৫২ দিয়ে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে সালাম বরকত রফিক জব্বার তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার। একারণে বাঙালির এই মহান আত্মত্যাগকে গোটা বিশ্ব স্মরণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। ঠিক তেমনি ছত্রিশ জুলাই ও ফ্যাসিস্টের পতন তথা বাকস্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রতীক হয়ে থাকবে।
রক্তের মেলবন্ধনে সেতুবন্ধন হোক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত ছত্রিশ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ধরা দিক আগামীর প্রজন্মে। নবউদ্যোমে আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে চলুক একুশ ছত্রিশের চেতনায়। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হোক প্রতিটি হৃদয়।
লেখকঃ সাব্বির আহমেদ ; লেকচারার, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
Post Views: 48
এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ..