কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা নন্দলালপুর ইউনিয়নের চর বহলা গোবিন্দপুরের কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ মনিরুজ্জামান। চলতি বছরে লিচু ও মেহগনি বাগানের ৫ একর নিজস্ব জমিতে সমন্বিত চাষ পদ্ধতিতে আন্ত ফসল হিসেবে চাষ করছেন ৬০ হাজার বস্তা আদা। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে উৎপাদিত আদার বাজার মূল্য ছাড়াবে কোটি টাকা।
বাঙালির নিত্য দিনের রন্ধনশালায় খাবারের স্বাদ বাড়াতে আদার জুড়ি মেলা ভার। তবে শুধু মুখের রুচি বাড়াতেই নয় আদিকাল থেকে ভেষজ ঔষধি গুনসম্পন্ন আদা বদ হজম ,সর্দি, কাশি, আমাশয়, জন্ডিস ও পেট ফাঁপা নিরাময়ের উল্লেখযোগ্য ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষি বান্ধব সরকারের ঘোষণা এক ইঞ্চি জায়গাও যেন অনাবাদি না থাকে। সরকারের এই ঘোষণা ই যেন নাড়া দেয় গার্মেন্টসের এক্সেসরিজ ব্যবসায়ী ও কৃষি উদ্যোক্তা কুমারখালীর চরবহলা গোবিন্দপুরের মৃত আব্দুল বারী শেখের পুত্র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। গার্মেন্টস ব্যবসায় ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পরায় ইউটিউব দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিকল্প রুজির পথ হিসেবে বেছে নেন আদা চাষ। ইতিমধ্যে যা এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছে।
সরজমিনে মনিরুজ্জামানের গোবিন্দপুরের কৃষি খামারে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৫ একর লিচু ও মেহগনি বাগানে সারি সারি হাজার হাজার বস্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ আদা গাছের ডগা। যে গুলোর পরিচর্যাতে রয়েছে ৫ জন স্থায়ী এবং ২০জন অস্থায়ী শ্রমিক। সমগ্র প্রজেক্টটির রয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎও সেচ ব্যবস্থা ।এছাড়া ও সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
পরিচর্যা তে ব্যস্ত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আদা চাষের জন্য প্রথমে পলি -দোআঁশ মাটি সংগ্রহ করা হয়। শোধনের পর ভার্মিক কম্পোস্ট, ছাই, গোবর সার, সামান্য বালি ও বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক সারের মিশ্রণে তৈরি মাটি ভরা হয় ছিদ্রযুক্ত সিমেন্টের প্যাকেটে। ৭৫ গ্রামের এক থেকে দুইটি আদার কন্দ রোপন করা হয় প্রতিটি বস্তায়। সব মিলে প্রতি বস্তায় খরচ হয় ৪৫- ৫০ টাকা।
মাটিতে আদা চাষ করলে মাটির আদ্রতা রক্ষা করা যায় না।এতে ঘাসের যন্ত্রণায় মাটি শক্ত হয়ে যায়। ফলে আদার বিস্তারে বাধা প্রাপ্ত হয়ে ফলন কমে যায়। আবার বর্ষাকালে মাটিতে পানি জমে আদা পঁচে যায়। কিন্তু বস্তা পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে এ ধরনের কোন ঝুঁকি থাকে না। বস্তায় মাটি নরম থাকে ঘাস কম হয় আবার ছিদ্র থাকায় পানী ও জমেনা। তাই এই পদ্ধতিতে স্বল্প খরচ ও শ্রমে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
কৃষি বিভাগ জানা,সাধারণত চৈএ থেকে বৈশাখ মাসে বস্তায় আদা রোপন করতে হয়। রোপনের তিন মাসের মধ্যে আদা হতে শুরু করে এবং (২৭০-২৯০) দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। গড়ে প্রতি বস্তায় ফলন হয় ১-১.৫ কেজি। প্রতি কেজি ২০০ টাকা দরে যার বাজার মূল্য দাঁড়াবে সোয়া কোটি টাকা। তবে আদা গাছের প্রধান রোগ কন্দপচা থেকে রক্ষা পেতে ও সঠিক ফলন নিশ্চিত করতে নিয়মিত ছত্রাক ও কীটনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন পড়ে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভোজন রসিক বাঙ্গালীর কাছে বহু গুণসম্পন্ন আদার চাহিদা বরাবরই তুঙ্গে। বিশাল এই চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থের আদা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই অর্থের মাত্র তিন শতাংশ কৃষকের প্রশিক্ষণে ব্যয় করলে আদার উৎপাদন বাড়বে তিন থেকে চার গুণ। যেটি আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীন চাহিদা পূরণ করে দেশকে নিয়ে যাবে রপ্তানির দিকে। আর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আবাদী, পতিত কিংবা বাঁশ ঝাড়ের পাশাপাশি বাসার ছাদ ,বেলকনি বা বাড়ির আনাচে কানাচের পরিত্যক্ত জায়গায় বস্তায় আদা চাষ রাখবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ।
প্রজেক্টের মালিক কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ মনিরুজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, শুরুতে এক লক্ষ বস্তা আদা চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বীজের অপ্রতুল্যতা হেতু সেটি সম্ভব হয়নি। বাজার থেকে দেশীয় চিটাগাং এবং বার্মা জাতের সাড়ে চার টন আদা বীজ সংগ্রহ করে ৬০ হাজার বস্তায় রোপন করি। কাঙ্খিত ফলন ও দাম পেলে আগামী মৌসুমে ১ লক্ষ বস্তা আদা চাষ করব। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সার্বিক সহযোগিতাও কামনা করেন এই উদ্যোক্তা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম কৃষি উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামানের এই ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমরা ইতিমধ্যে মনিরুজ্জামানের প্রজেক্ট পরিদর্শন করেছি। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিস সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই উপজেলায় বস্তায় আদা চাষকে উৎসাহিত করতে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও জানান তিনি।