বিচার বিভাগের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ এবং মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করলেও বাস্তবে এই স্বাধীনতা কতটা সুরক্ষিত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থা, মোবাইল কোর্ট এবং জজ কোর্ট থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা কিছু উদাহরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘাটতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবার অবকাশ তৈরি করেছে। উচ্চ আদালতের একজন বিচারক পদত্যাগের আগে বলেছিলেন, “আমি স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারি না” (ডেইলি স্টার, আগস্ট ২০২৩)। তাঁর এই বক্তব্য রাজনৈতিক চাপের কারণে স্বাধীনভাবে বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের স্পষ্ট উদাহরণ।
একটি সংবেদনশীল মামলায়, উচ্চ আদালতের বিচারকরা বেশ কয়েকবার বলেছেন, “আমরা স্বাধীন বিচার করতে পারছি না, বাইরে থেকে চাপ আছে” (প্রথম আলো, এপ্রিল ২০২৩)। এই ধরনের পরিস্থিতি বিচারকদের স্বাধীনভাবে রায় দিতে বাঁধা সৃষ্টি করে এবং ন্যায়বিচারের সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়। আদালতে রাজনৈতিক চাপের প্রভাব বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমের প্রসঙ্গে, “মোবাইল কোর্টের নাম দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার করছে” (সমকাল, সেপ্টেম্বর ২০২৩) শিরোনামে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়মের অভিযোগে সমালোচিত হয়েছে। নির্বাহী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত এই বিচারিক কার্যক্রম অনেক সময় আদর্শ বিচারিক প্রক্রিয়া পালিত হচ্ছে না, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘাটতির আরেকটি দিক তুলে ধরে। “গ্রাম সালিশে প্রভাবশালীদের দাপটে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না” (প্রথম আলো, অক্টোবর ২০২৩) শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সালিশি সভায় রায় দিয়ে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
জজ কোর্ট পর্যায়েও বিচারকের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপের প্রভাব দেখা যায়। “রাজনৈতিক চাপের কারণে বিচারক বদলি: বিচার বিভাগে স্বাধীনতা সংকটে” (নিউ এজ, ফেব্রুয়ারি ২০২৩) শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ার গুরুত্ব উঠে এসেছে। এই ধরনের চাপ বিচারকদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস করে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
রাজনৈতিক মামলাগুলোতে জজ কোর্টের বিচার বিলম্বিত করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। “রাজনৈতিক মামলায় বিচার বিলম্বিত: বিচার বিভাগে সংকট” (বাংলা ট্রিবিউন, জুন ২০২৩) শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যা স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করছে।
এই সব উদাহরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঘাটতি প্রমাণ করে এবং সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের উচিত বিচারকদের কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা দেওয়া। বিশেষত, বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও কর্মসংস্কৃতিতে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন। মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধে এবং গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
সকল স্তরের বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ রাখা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো সুরক্ষিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখা শুধু গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্যও অপরিহার্য।